প্রতীকি ছবি-সংগ্রহ |
এইচ আর রাসলে : যখন বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, তখন এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। তেমনি করে যখন বলা হয় শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। শিশুরাই আগামী দিনের পথপ্রদর্শক তখনও এ কথার বিরোধিতা করবেন এমন লোক নেই। তাহলে জাতির মেরুদন্ড ‘শিক্ষা’ গ্রহণ করতে গিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের মেরুদন্ডকে কেন ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে? কেন শিশুর প্রায় সমপরিমাণ ওজনের স্কুল ব্যাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের কোমল কাঁধে? এর জবাব আমরা অনেকেই জানি ।এর ক্ষতিকর দিকটাও সবার জানা। তারপরেও সকলের চোখের সামনে এই অমানবিক আচরণ চলছে অবলীলায় উৎসবের সাথে! এ দেশের আদালত শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের স্কুলব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করে আইন প্রয়োগ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে রুল জারি করেছে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে সে রুলের আর কোনো সুরাহা আমরা দেখতে পাইনি। ফলে অভিভাবক, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, প্রশাসন সকলের সামনে দিয়েই কোমলমতি শিশুরা তাদের ওজনের প্রায় সমপরিমাণ স্কুল ব্যাগ বহন করতে গিয়ে শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ছে। তাদের মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পিঠে, পায়ে ব্যথা সহ্য করছে। শারীরিক দূর্বলতা নিয়ে ধুকে ধুকে বড় হচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের কিন্ডারগার্টেনসহ সরকারি বেসরকারি স্কুলগুলোর দৃশ্য প্রায় একই রকম। কাকডাকা ভোরে ঘুম ঘুম চোখে সামর্থ্যরে বাইরের এক বোঝা বইয়ের ব্যাগ নিয়ে কুাঁজো হয়ে হেঁটে যাচ্ছে সন্তান। পিছনে নিরুপায় অভিভাবক মাঝে মাঝে নিজেই তুলে নিচ্ছেন ব্যাগ সন্তানকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। স্কুলে যাওয়ার সময় একবার এবং স্কুল ছুটির পর আরেকবার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরকে স্কুল ব্যাগের এই অতিরিক্ত বোঝা বইতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। তারপর কোচিং ও শিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়া আসার সময়ও এই শ্রম দিতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
ঢাকাসহ সারাাদেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় প্লে, নার্সারি, কেজি শ্রেণির শিশুদের জন্য বাংলা বর্ণ পরিচয়, বাংলা ছড়া, ব্যাকরণ, ইংরেজি বর্ণ পরিচয়, রাইমস, গ্রামার, অ্যাক্টিভ ইংলিশ, ওয়ার্ড বুক, সাধারণ জ্ঞান, ছবি আঁকাসহ ১০ থেকে ১৫টি বই তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। এছাড়াও তাদের ডায়েরি, খাতা –কলম, পেন্সিল বক্স, পানির ফ্লাক্সতো আছেই। ১ম ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য সরকার নির্ধারিত বাংলা, অংক ও ইংরেজি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হলেও তাদেরও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির ধরিয়ে দেওয়া প্রায় ১৫টি বই। তেমিনভাবে ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ৬টি বইয়ের বাইরে রয়েছে গ্রামার, ব্যাকরণ, নোট-গাইডসহ অন্যান্য বেশ কিছু ভারী ওজনের বই যা বহন করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তারা দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে আর পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। খেলাধুলা বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও সময় না পাওয়ায় জীবন হয়ে যাচ্ছে রোবটের মতো অনেকটাই যান্ত্রিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শিশুদের প্রতি কেন এ নির্মমতা? হেসে খেলে যাদের শৈশব পার হওয়ার কথা কুলির মতো কেন তাদের পাহাড়সম বইয়ের বোঝা বইতে হয়? কাদের স্বার্থে এই অনিয়ম? এটা আমরা সবাই জানি। এক শ্রেণির পুস্তক ব্যবসায়ী, প্রশাসনের কিছু সুবিধাবাদী আমলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু লোভী শিক্ষক, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির কিছু বিবেকহীন প্রাণীর স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়েই কোমলমতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতি এই নির্দয় আচরণ। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে তৈরি হয় বিভিন্ন কোম্পানির বই। তারপর শিক্ষক , সমিতি কিংবা বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাথে লিয়াজো করে , ডোনেশনের মাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন উপায়ে সেগুলো পাঠ্য হয় স্কুল,কিন্ডারগার্টেনে। অতঃপর স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের হাতে ধরিয়ে দেন ফরমায়েশি ‘বুক লিস্ট’। সেই বুক লিস্ট ধরে একান্ত অনুগত ছাত্রের মতো বই কিনে নিয়ে আসেন অভিভাবকবৃন্দ। সেক্ষেত্রে দাম যতই হোক তাকে বুক লিস্ট ধরেই বই কিনতে হয়। কেননা অভিযোগ আছে অন্য বই থেকে উত্তর লিখলে শিক্ষকরা নম্বরও দেন না। এমনি করেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন, স্বাস্থ্য আর নির্মল শৈশব নিয়ে ছিনিমিনি খেলছি আমরা কতিপয় স্বার্থবাজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন