বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
-এইচ আর রাসেল
ভূমিকা : পৃথিবীতে কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম হয় যারা তাদের কর্ম দিয়ে এ সমাজকে, জাতিকে আলোকিত করেন। মানুষ তাদের ভালোবেসে হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই দেয় আর আমৃত্যু শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে। এ দেশে তেমনি একজন ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে। যার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। যার হাত ধরে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার মানুষ ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অবিচ্ছেদ্য নাম। একটি ছাড়া আরেকটি যেন অর্থহীন।
জন্ম ও শৈশবকাল : বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার (পূর্বের ফরিদপুর) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান তৃতীয়। ছোট বেলায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত চটপটে স্বভাবের। খেলাধুলা ও দিনভর ঘুরে বেড়ানো ছিল তার শৈশবের নিত্যকর্ম। খালে-বিলে সাঁতরে বেড়াতে তার ভালো লাগত। ফুটবল খুব ভালো খেলতেন তাই স্থানীয় ফুটবল দলে ছিল তার শক্ত অবস্থান। ছোটবেলায় তার নাম ছিল খোকা। আপনজনেরা ভালোবেসে তাকে এ নামে ডাকতেন ।
কৈশোরে বঙ্গবন্ধু: কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিক দক্ষতা ও নৈতৃত্বের প্রমাণ রাখেন। ১৯৩৮ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১৮ তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মহকুমা পরিদর্শনে আসেন। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শন শেষে চলে যাওয়ার সময় অত্র স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পথ আগলে দাঁড়ান। তারপর তার স্কুলের ভাঙ্গা ছাদ বেয়ে পানি পড়া, খেলার মাঠের দূরাবস্থা, জরাজীর্ণ ছাত্রাবাস, ব্যায়ামাগার সংকট, পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই সংকট সহ অন্যান্য অসুবিধার কথা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। তার স্পষ্ট ভাষণ এবং সৎসাহস দেখে তারা খুশি হন এবং তৎক্ষণাৎ এসব সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন।
ছাত্র জীবনে বঙ্গবন্ধু : গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্র জীবন শুরু হয়। তারপর গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৬ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আইন বিষয়ে পড়া শোনা করেন।
বর্ণীল রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু : তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় ১৯৪০ সাল থেকেই। তৎকালীন সময় তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর। ১৯৪৮ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা’র দাবিতে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। এ বছরেরই ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হরতাল পালনের সময় তিনি গ্রেফতার হন। জেলে বসেই তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় গতি সঞ্চার করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম গঠিত হলে তিনি সে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংগঠনিক দক্ষতা এবং দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে তিনি ১৯৫৩ সালে একই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচতি হন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের হয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং জয়লাভ করেন। একইসাথে তিনি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীপরিষদের মন্ত্রীত্বও লাভ করেন। ১৯৬৬ সাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ বছর তিনি তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। যাকে বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই ছয়দফার উপর ভিত্তি করেই বাঙ্গালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। এই ছয় দফার জনপ্রিয়তায় ভিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে দেওয়া হয় আগরতলা ষরযন্ত্র মামলা। বার বার গ্রেফতার করা হয় তাকে। কিন্তু জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি সরকার এ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। বঙ্গবন্ধু মুক্ত হন। তার পরদিন ২৩ ফেব্রæয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলাকে বাংলাদেশ নামকরণে ভূষিত করেন।
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়ে দেন। সেই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের একচেটিয়া সমর্থন পেলেও পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে দেশের মানুষ স্বাধীনতার নেশায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। যা ৭ই মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু আর অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী উত্তাল জনতা। সেদিন প্রায় দশ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ দিলেন। তার দরাজ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করতে হবে... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। উপস্থিত জনতা সেদিন বুঝে নিলেন আর সময় নেই এবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পালা। তখন থেকেই কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের উপর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুও তার বিভিন্ন ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান না বলে বাংলাদেশ উচ্চারণ করতে থাকেন। ২৩ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫ মার্চ কালরাত। বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক রাত। সেদিন রাত ১১টা ৩০মিনিটের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাতের আঁধারে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ আর অগ্নিসংযোগ। ঢাকার রাজপথে শুধু রক্ত আর রক্ত! হামলার কিছুক্ষণ পরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার সেই ঘোষণা ওয়ারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খন্ড, প্রথম পাতা) সেই রাতে আরও একবার বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণাটি বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে প্রচার করা হয়। রাত ১.৩০ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২নং বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধু : যুদ্ধকে সুচারুরূপে পরিচালনা করার জন্য ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেকটি সেক্টরে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধের কলাকৌশল থেকে শুরু করে তাৎক্ষণিক সব দিকনির্দেশনা এই সরকার প্রদান করে। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এই সরকারের মূল চালিকাশক্তি।
অতঃপর বিজয় : বঙ্গবন্ধুর ডাকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি বীরের মতো যুদ্ধ করে। অবশেষে আসে সেই কাঙ্খিত বিজয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। বাঙালির স্বপ্ন পূরণের দিন। দীর্ঘ নয়মাস রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনী সেদিন তাদের কমবেশি ৯০ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে। ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ আর ২ লক্ষ মাবোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে সদর্পে জায়গা করে নেয় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আকাশে পত পত করে উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা।
শেষ কথা : এক সাগর রক্তে পাওয়া এই বাংলাদেশ নামের সাথে এই পতাকার সাথে যার নাম মিশে আছে তিনি আমাদের বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাঙালি থাকবে, এই মানচিত্র থাকবে এদেশের পদ্মা, মেঘনা থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে সগৌরবে, কৃতজ্ঞতায়।