নজরুল ছাড়া এত বিশেষণ আর কাউকে দেওয়া যায় কি?
এইচ আর রাসেল : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সাহিত্য জগতের নবাব হয়ে বিশ্বের মাঝে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। চারদিকে তার জয়জয়কার। তার সমসাময়িক লেখকেরা কমবেশি তারই ঘরানা অনুসরণ করে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে কেউ একজন সম্পূর্ণ রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে গিয়ে নরম কোমল সাহিত্য জমিনে যেন বোমা ফাটাতে আরম্ভ করলেন। একের পর এক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখে সবার ঘুম হারাম করার যোগাড় প্রায়। সবার কৌতুহল পাহাড়সমান হয়ে উঠল। কে সেই নবাগত? রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র রাজত্বে ভাগ বসানোর জন্য ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে এগিয়ে আসছে কে? সকলেই খোঁজ খবর করে দেখল একি! এ যে পুঁচকে ছেলের কান্ড! এই রোগামাটা শান্তশিষ্ট বালকের মাথায় সাহিত্যের পোকাটা ঢুকলো কীভাবে? কে সে? কী তার নাম? কীইবা তার পরিচয়? সকলেই তার পরিচয় জানল। তার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। কখনো কুসুম কোমল, কখনো বজ্রকঠিন লেখার মাধ্যমে সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়া নজরুল।
নজরুলের কর্মজীবন (বাকশক্তি হারানোর আগ পর্যন্ত) পর্যালোচনা করলে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই। একজন মানুষের চিন্তায় এত বৈচিত্রতা, এত ভিন্নতা, জীবনকে নিয়ে এত গভীর উপলব্ধি আর কারও লেখনিতে এত প্রকট হয়ে ফুটে উঠেনি। এতো বিশেষণ আর কোনো কবির ভাগ্যে জুটেনি।
ছোটদের জন্য তাঁর রচিত সংকল্প, প্রভাতী, খুকি ও কাঠবিড়ালী, চড়ুই পাখির ছানা, লিচু চোর ইত্যাদি রচনাগুলো পড়লে তাঁকে নিতান্তই শিশুদের কবি ছাড়া ভাবা যায় না। আবার ভাঙ্গার গান, ছাত্রদলের গান, রণসঙ্গীত- চল চল চল, কান্ডারি হুশিয়ার ইত্যাদি অসংখ্য রচনায় তাঁকে তারুণ্যের কবি বললেই যেন সঠিক বলা হয়। আবার যখন তার সাম্যের গান, মানুষ, সাম্যবাদী, কুলি ও মজুর, দারিদ্রসহ এমন আরও অসংখ্য রচনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখন আমরা তাঁকে সাম্যের কবি, মানবতার কবি ছাড়া আর কীইবা বলতে পারি? অন্যদিকে তার শিকল ভাঙ্গার গান, প্রলয়োল্লাস, কামাল পাশা, ভাঙ্গার গান, বিদ্রোহী ইত্যাদি খুরধার রচনা পাঠ করে তাকে বিদ্রোহের কবি বলবে না এমন সাধ্য কার?
তিনি শুধু শিশুদের কবি, সাম্যের কবি কিংবা তারুণের কবিই নয়। এমন রক্ত টগবগ করা বিদ্রোহীর মনে প্রেমও যে জেগেছিল! শুধু কি প্রেম? তাঁর মতো এমন গভীর প্রেমানুভূতির প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে দেখাতে পেরেছে কজন বলুন! মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, প্রিয় এমন রাত যেন যায়না বৃথায়, আলগা করোগো খোপার বাঁধন, আধখানা চাঁদ উঠিছে আকাশে আধখানা চাঁদ নিচে ইত্যাদি অসংখ্য প্রেমের গানের জনক যে আমাদের নজরুল! তার মানে তাঁকে আমরা প্রেমের কবিও বলতে পারি অনায়াসেই।
আচ্ছা এবার আসুন নজরুলের ধর্মদর্শনের দিকে। ধর্মদর্শনেও যেন নজরুল অদ্বিতীয়। কারণ ধর্মের গভীরে গিয়ে এর প্রকৃত মর্মবাণী উপলব্ধি করে ধর্মকে সকলের মাঝে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে এমন কবির সংখ্যা এদেশেতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শোন শোন ইয়া ইলাহি আমার মুনাজাত, রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার, ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল, মোহাম্মদ নাম যতই জপি, খোদা এই গরিবের শোনো শোনো মুনাজাত, ও মন রমজানেরই রোজার শেষে ইত্যাদি অসংখ্যা ইসলামী গানের যে ভান্ডার নজরুল রেখে গেছেন মুসলিম জাতি পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত তা মনে রাখবে। শুধ তার নিজের ধর্মই নয়। অসাম্প্রদায়িক কবি নজরুল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য রেখে গেছেন তার অসংখ্য সৃষ্টি। ওমা তোর চরণে কি, এবার নবীন মন্ত্রে হবে, এলো নন্দের নন্দন নব ঘনশ্যাম সহ অসংখ্য গান রয়েছে তার সৃষ্টকর্মে। তাছাড়া ভজন, কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীতের জন্যতো নজরুল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবতাতুল্য হয়ে আছেন। তাহলে নজরুল তার নিজ ধর্মের প্রতি শতভাগ ভক্তি শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন রেখে অন্য ধর্মের জন্যও যে সৃষ্টি রেখে গেছেন আমরা তাকে অসাম্প্রদায়িক কবি বললে বাড়িয়ে বলা হবে কি?
এখানেই শেষ নয় নজরুলের বহুমুখী প্রতিভা। নজরুল ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সাংবাদিক। তার সম্পাদনায় ধুমকেতু,দর্পণসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা বৃটিশ সাম্রাজ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। নজরুল ছিলেন একজন পেশাদার গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ভক্ত ধ্রæব, পাতালপুরী, বিদ্যাপতি, গোরাসহ বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি সুনামের সাথে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয় কয়েকটি ছবিতে তিনি নিজ কণ্ঠে গান গাওয়াসহ অভিনয়ও করেছেন। তার রচিত নাটক, উপন্যাস,প্রবন্ধ এমনকি বিভিন্ন সভা সমিতিতে তার প্রদত্ত ভাষণগুলোও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। আর গানের কথাতো বলাই বাহুল্য। গান রচনা, সুরারোপ ও স্বরলিপি প্রয়োগে নজরুলের সমকক্ষ কেবলই রবীন্দ্রনাথ। তবে কোথাও কোথাও তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন নজরুল। একই সাথে এত বৈচিত্রময় গান, সুর, তাল, ও নতুন রাগের সৃষ্টি আর কোনো সাধক করে যেতে পারেননি। (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি।)
এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে নজরুলের কাব্য প্রতিভা প্রকাশের সাধ্য কারও নেই। শুধু এইটুকু বলে শেষ করতে চাই-জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে দারিদ্রের সাথে, দুঃখের সাথে, যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে করে নজরুল যে বৈচিত্রময় প্রতিভার পরিচয় রেখে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলেন শিশুদের কবি, তারুণ্যের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, অভিনেতা, সুরকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার। সর্বোপরি তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে একজন অনন্য অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ।