কী বিভৎস আমাদের মানবতা!
-এইচ আর রাসেল
প্রাণ আছে বলে আমি একজন প্রাণী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন সন্দেহ নেই বনের বাঘ, বানর, শিয়াল কিংবা গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির ক্ষেত্রেও। তারা প্রাণী হয়েই জন্মে প্রাণী হয়েই মৃত্যুবরণ করে। তাদের আর মানুষ হওয়ার সুযোগ নেই। তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু প্রাণী হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও মানবপ্রাণীগুলোর মানুষ হওয়ার সুযোগ আছে। আর এর প্রয়োজনটাই মুখ্য। মানুষের মধ্যে বিবেক নামক একটি অদৃশ্য অথচ প্রচন্ড শক্তিশালী একটা বিষয় আছে। যাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ শুধু প্রাণী থেকে বিবেকবোধ বা মানবতাবোধসম্পন্ন একজন মানুষ হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এ পৃথিবীতে আমরা মানবপ্রাণীগুলোর অধিকাংশই মৃত্যু অবধি শুধু প্রাণীই থেকে যাই মানুষ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারি না। অবশ্য প্রাণীতে প্রাণীতেও তফাত আছে। নিরীহ প্রাণীগুলো প্রাণী হয়েও সমাজের অনেক উপকারে আসে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি তেমন। আবার শুকর কিংবা হায়েনার মতো প্রাণীও আছে যাদের হিংস্রতায় অন্যান্য প্রাণীগুলো সর্বদাই থাকে ভীত সন্ত্রস্ত।
বলতে দ্বিধা নেই আজকের সমাজে শুকর, হায়েনাদের মতো মানবপ্রাণীগুলোর আধিক্যই যেন সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে আজ তাদেরই রাজত্ব। অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মান আজ যেন তাদেরই প্রাপ্য। বিবেকবোধ, মানবতাবোধ এ শব্দগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে, মানুষের অন্তর থেকে। মায়া, মমতা, পারিবারিক বন্ধন,সহমর্মিতা আর প্রেম ভালোবাসার অনুভূতিগলোতে কেমন যেন মরিচা ধরে গেছে। তারই ফলশ্রæতিতে আজ সমাজে অহরহই ঘটে চলেছে পিলে চমকে উঠার মতো ঘটনা! যা শুনলে যা দেখলে নিজেকে মানুষ ভেবে পশুর কাছে লজ্জিত হই!
আজ আমরা এতটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি যে এক গজ দূরত্বের পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশীর খবর রাখি না। রাস্তায় অন্যায়ভাবে কাউকে মেরে ফেলতে দেখলেও না দেখার ভান করে দ্রæত সটকে পড়ি। কেউ কেউ এ অমানবিক ঘটনা মোবাইলে ধারণ করি, দূরে দাঁড়িয়ে আগ্রহের সাথে অপলক চেয়ে থাকি কেউ কেউ। কিন্তু কেউ এগিয়ে গিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করি না।
কারণে অকারণেই খুনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে আজকাল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক কারণে প্রতিদিনই নৃশংসভাবে খুন হচ্ছে মানুষ। ক্ষমতার লোভ, প্রতিপক্ষের উপর আধিপত্য বিস্তার, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের ভাগবাটোয়ারা, জমি-জমা নিয়ে বিরোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে পরকিয়াচর্চা, এমনকি সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্ধের মতো নিছক ঘটনায়ও খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ। দিনে দুপুরে জনসম্মুখে কুপিয়ে খুন করা, কিংবা অপহরণ করার পর খুন করে লাশ টুকরো টুকরো করে গুম করে ফেলা, কিংবা কোনো বিলের ধারে কিংবা রাস্তার পাশে ফেলে রাখা এ যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে আজকাল।
এদিকে সমাজে ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে আশংকাজনক হারে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালে কিংবা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার খবরগুলো দেখতে পাই। ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে চল্লিশোর্ধ্ব নারীরাও ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছেন। গার্মেন্ট কর্মী, ছাত্রী, কর্মজীবি, গৃহবধু,এমনকি প্রতিবন্ধী নারী-শিশু কেউ বাদ যাচ্ছে না এ তালিকা থেকে। অন্যদিকে ধর্ষকের তালিকায় চলে আসছে ভবঘুড়ে কিশোর, ছাত্র, দিনমজুর, ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত, স্কুল শিক্ষক, মাদ্রাসার হুজুর এমনকি মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে স্বয়ং পিতার বিরুদ্ধেই! কী বিভৎস, কী ভয়ংকর অবস্থায় রয়েছে আমাদের বিবেক, আমাদের মানবতা!
অন্যদিকে নিজের পরকিয়া জীবনকে মসৃণ করতে গিয়ে নিজের সন্তানকে খুন করছেন মা! স্বামীকে খুন করছেন স্ত্রী এবং স্ত্রীকেও খুন করছেন স্বামী! শুধু তাই নয় আজকাল রাস্তায়, ডাস্টবিনে কিংবা হাসপাতালের পাশে ময়লার স্তুপে পাওয়া যায় অবৈধ সম্পর্কের নবজাতক মানব সন্তান! কোথায় যাচ্ছি আমরা? আর কত নীচ হবো আমরা? এদিকে মানবতা ও বিবেক ভূলুন্ঠিত হচ্ছে বিবেকবোধহীন সন্তানের মধ্যেও। যার ফলে দেশে দিন দিন বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। যে মায়ের বুকের দুধ খেয়ে সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন সে সব অকৃতজ্ঞ সন্তানরা তাদের বৃদ্ধা মায়েদের রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যাচ্ছেন এমন ঘটনার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ মানবতা আর বিবেকহীন কর্মের মহোৎসব চলছে। ভেবে দেখুন আপনি আমি রোজ বেঁচে থাকার জন্য যে খাবারগুলো খাই তার মধ্যে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, দুধ, ডিম, সবজি, তরকারি, ফলমূল ইত্যাদি প্রধান। অথচ এসব উপাদানের প্রায় প্রতিটিতেই মেশানো আছে ভেজাল, আছে ফরমালিন নামক বিষ! ফলে দীর্ঘদিন এ ভেজাল আর ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে খেয়ে মানুষ হার্ট, কিডনি, লিভার, ব্রেইনের মতো মারাত্মক অঙ্গের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মরনব্যাধি ক্যান্সারেও। এখানেও একশ্রেণির বিবেকহীন মানবরূপী পশুর নোংরা শিকার সাধারণ মানুষ! বিবেকবোধের বিশাল শূণ্যতা এসব পিশাচদের নরপশুতে পরিণত করেছে।
এখানেই শেষ নয় মানুষ অস্স্থু হওয়ার পর স্্রষ্টার পর যার উপর ভরসা করেন সেই ডাক্তারগণের অনেকেই আজকাল বিবেকবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যবসায়ী ও কসাই হয়ে গেছেন। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে টেস্ট দিয়ে কমিশন নেওয়া, অপারেশনের জন্য আকাশচুম্বি ফি, নিজেদের অযৌক্তিক ফি নিয়ে রোগীকে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, অখ্যাত সব কোম্পানির ঔষধ প্রেসক্রাইব করে কমিশন নেওয়া, টাকা ছাড়া রোগী ভর্তি না করানো, লাশ বের হতে না দেওয়া এমনকি মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রেখে লক্ষ টাকা বিল আদায়ের মতো ভয়ংকর অভিযোগও পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে। ভাবা যায় কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথায় যাচ্ছে আমাদের মানবতা?
দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দুঃখজনক হলেও সত্যি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকের বিরুদ্ধেও আছে অমানবিক আচরণের বিস্তর অভিযোগ। ক্ষমতাবান অপরাধীদের মামলা না নেওয়া, সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়, বিশেষ সুবিধা নিয়ে অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া, মাদক ব্যবসা, থানা হেফাজতে মারধরের পর আসামীর মৃত্যু এমনকি ধর্ষণের মতো অভিযোগও উঠছে তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে!
এমনি করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিবেক আর মানবতার অভাবে ভরসা আর আস্থার জায়গাগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হিংস্র পশুর সাথে আমাদের পার্থক্যটা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের বিবেককে জাগ্রত না করবো, লোভ, প্রতিহিংসা পরিত্যাগ না করবো, মিথ্যা আর অসুন্দরকে পরিত্যাগ না করবো ততদিন পর্যন্ত আমরা মানুষ না হয়ে শুধুমাত্র প্রাণীই থেকে যাবো। আর মানুষের অবয়ব নিয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে মৃত্যুবরণ না করতে পারলে এ জীবনটা যে কেবলই নিরর্থক হয়ে থাকবে।